বাজারে ভারসাম্যহীনতা - বিস্তারিত ব্যাখ্যা
বাজারে ভারসাম্যহীনতা (Market Disequilibrium)
বাজারে ভারসাম্য তখন সৃষ্টি হয় যখন চাহিদার পরিমাণ = সরবরাহের পরিমাণ এবং মূল্য স্থিতিশীল থাকে। যখন এই সমতা ভেঙে যায়, তখন বাজারে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। নিচে কারণগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো।
১. চাহিদার আকস্মিক পরিবর্তন
কারণ:
- কোনো পণ্যের জনপ্রিয়তা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া
- আয় বৃদ্ধি বা হ্রাস
- ঋতুভেদে চাহিদার পরিবর্তন
- বিকল্প পণ্যের দাম পরিবর্তন
ফলাফল: চাহিদা বেড়লে দাম বাড়ে এবং সরবরাহ কমতে পারে; চাহিদা কমলে অতিরিক্ত পণ্য জমে দাম পড়ে।
উদাহরণ: শীতে গরম কাপড়ের চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে এবং বাজারে ভারসাম্য নষ্ট হয়।
২. সরবরাহের পরিবর্তন
কারণ:
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়)
- কাঁচামালের অভাব
- শ্রমিক সংকট
- পরিবহন ব্যাহত হওয়া
- উৎপাদন প্রযুক্তির হঠাৎ পরিবর্তন
ফলাফল: সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে; অতিরিক্ত সরবরাহ হলে দাম কমে—দুটোই বাজারকে অস্থিতিশীল করে।
উদাহরণ: বন্যায় তরমুজ/শাকসবজি নষ্ট হলে দাম দ্রুত বেড়ে যায়।
৩. সরকারের নীতি পরিবর্তন
কারণ: মূল্য নিয়ন্ত্রণ, ভর্তুকি পরিবর্তন, আমদানি-রপ্তানি নীতি, কর আরোপ ইত্যাদি।
ফলাফল: সরকারি হস্তক্ষেপ বাজারের স্বাভাবিক কাজকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।
উদাহরণ: মূল্যসীমানা (price ceiling) kalau প্রযোজ্য হলে সরবরাহহীনতা তৈরি হতে পারে।
৪. উৎপাদন ব্যয়ের ওঠানামা
কারণ: কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি, জ্বালানি দাম বেড়া—এগুলো উৎপাদন ব্যয় বাড়ায়।
ফলাফল: ব্যয় বেড়ে উৎপাদন কমলে সরবরাহ কমে এবং মূল্য বেড়ে যায়, ফলে ভারসাম্য নষ্ট হয়।
উদাহরণ: ডিজেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বেড়ে সব পণ্যের মূল্য অনুপ্রাণিতভাবে বাড়ে।
৫. তথ্যের অসমতা (Information Asymmetry)
যখন বাজারে অংশগ্রহণকারীরা সমান তথ্য পায় না, তখন তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে—যা চাহিদা বা সরবরাহকে বিকৃত করে।
উদাহরণ: যদি ক্রেতারা ভাবেন কোনো পণ্যের দাম বাড়বে, তাহলে তারা মজুদ শুরু করে—এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়।
৬. বাজারে একচেটিয়া ক্ষমতা (Monopoly / Oligopoly)
কিছু ক্ষেত্রে এক বা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাজার নিয়ন্ত্রণ করে দাম ও সরবরাহ নির্ধারণ করতে পারে—এতে বাজারের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
উদাহরণ: ইউটিলিটি সেক্টর বা কিছু উচ্চ-প্রযুক্তি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কম থাকলে দাম কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
৭. ভোক্তার রুচি ও পছন্দ পরিবর্তন
বিজ্ঞাপন, স্বাস্থ্য সচেতনতা, নতুন ফ্যাশন ইত্যাদি ভোক্তার রুচি বদলে দিলে চাহিদা সরাসরি প্রভাবিত হয়।
উদাহরণ: স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে চিনির চাহিদা কমলে চিনির বাজারে ভারসাম্য বদলে যায়।
৮. প্রযুক্তিগত পরিবর্তন
নতুন প্রযুক্তি পুরনো পণ্যকে অপ্রচলিত করে দিতে পারে—এতে পুরোনো পণ্যের চাহিদা কমে এবং বাজারে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
উদাহরণ: স্মার্টফোনের আগমনে সাধারণ ফোনের চাহিদা কমে গিয়েছিল।
৯. আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা
বিশ্ববাজারে কাঁচামাল বা জ্বালানির দাম বাড়লে তা স্থানীয় বাজারকেও প্রভাবিত করে—ফলে ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।
উদাহরণ: তেলের দাম বেড়ে গেলে আমদানি নির্ভর দেশগুলোতে সবকিছুই দাম বেড়ে যায়।
১০. অপ্রত্যাশিত ঘটনা (Shocks)
মহামারি, রাজনীতি-সংকট, যুদ্ধ, শিল্পদুর্ঘটনা—এসব ঘটনা চাহিদা ও সরবরাহ উভয়কেই থমকে দিতে পারে।
উদাহরণ: COVID-19 মহামারী সময় অনেক উৎপাদন স্থপুর্ণ বন্ধ ও সরবরাহশৃঙ্খল ভেঙে পড়েছিল।
সংক্ষেপ
বাজারে ভারসাম্যহীনতার মূল সূত্র হলো: চাহিদা ≠ সরবরাহ। এটি হতে পারে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত, বা প্রাকৃতিক কারণে।
অতিরিক্ত: চাহিদা-সরবরাহের সাধারণ গ্রাফের ব্যাখ্যা (টেক্সট আকারে)
গ্রাফিক ছাড়া বোঝানোর জন্য বলা যায়—যদি মূল্য (P) এবং পরিমাণ (Q) অক্ষ হিসেবে ধরা হয়, তাহলে সরবরাহ ও চাহিদা দুটো লাইন সমান বিন্দুতে মিললে equilibrium হয়। কোনো এক কারণে চাহিদা লাইন ডানদিকে সরলে (বর্ধিত চাহিদা), equilibrium নতুন উচ্চ মূল্যে চলে যায়; অন্যদিকে সরবরাহ লাইন বামে সরলে (কমানো সরবরাহ), মূল্য বাড়ে এবং পরিমাণ কমে।
